ফেরদৌস আরা রুমী-এর পাঁচটি কবিতা
পলায়ন
মেঘনার কাছে গেলে
হু হু করে বুকের ভিতর
খালি গিলে খায় কেড়ে নেয়
দলা দলা মেঘ ভাসে
বাড়ি যায়!
সন্ধ্যা নামে নদীতে
চাঁদ ভাসে জলে
পূর্নিমার।
খলবলিয়ে ওঠে মাছেরা
চিক্চিক্ করে সেই জলে জ্যোৎস্না
দু’একটা একটা মাছ লাফ দিয়ে আবার ডুব দেয়।
খেলা ওদের।
জেলে নৌকাগুলো হ্যাজাক জ্বালায়
এবার কত রাত কাটবে
সে নিজেও জানে না।
পড়ে থাকে সংসার
মায়া, কচি কচি মুখ।
আহা! ঘরে থাকতে ছেলেমেয়েদের সাথে এত চ্যাঁচামেচি না করলেও হতো-
গ্লানিবোধ।
উনানের আগুনের সামনে বৌটার মুখ আগুন রাঙা
কত মমতায় কত যত্নে
সংসার আগলায়
বউয়ের মুখ ভাসে নিজের মধ্যে ফেরে
ফিরে আসে সংসারে।
ওদের সবার আছে বাড়ি ফেরা
সংসার, মায়া
ফিরে আসার তাড়া।
আর আমার?
শুধু ঘর পালানো বাকি!
৮ নভেম্বর, ২০১৬।
আমরা বৃদ্ধ হই
আমার একটা অনেক দিনের অপেক্ষা আছে
তোমার মনে পড়ে আমাদের আসা যাওয়ার পথে অশ্বত্থ গাছটা?
এখনো আছে মাথা উঁচিয়ে কতকাল আগের!
তখন হিসেব কষে দেখেছিলাম
আমাদের বাবার দাদার আমলের
তবে তার বয়স কত হলো?
অশ্বত্থের কোলে বসে আমরা সারাটা দিনের রোজনামচা লিখতাম
চুপটি করে কানখাড়া করে সব শুনতো সে
আর দারুণ আনন্দে বাতাস খেলাতো আমাদের গায়ে।
তোমার এখানে আনাগোনা থেমেছে অনেকদিন হলো।
আমি এখনো নিয়মকরে যাই বৃক্ষটার কাছে
একভাবে বসে আমাদের গল্প করি ঠিক
যেমনটা করতাম আগে।
জানো, আমাদের সেই গল্প শুনতে এখন কে কে আসে?
কাক, চড়ুই, কাঠবিড়ালী আর অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে একটা মুরগি।
কাল গিয়ে দেখি নতুন আরো এক বন্ধু জুটেছে ওদের,
শালিক!
গভীর মন দিয়ে ওরা সবাই আমার গল্প বলা শোনে তোমাকে নিয়ে।
সবচেয়ে বেশিবার শোনে তোমার আমার প্রথম দেখা হওয়ার গল্প
কতবার যে বলেছি ওদের! তাও-
এখন আমরা তোমার গল্প করতে করতে বৃদ্ধ হই।
৩ নভেম্বর, ২০১৬।
একটা ঝড় হতে যদি
একটা ঝড় এসে আমায় উড়িয়ে নিয়ে যেত যদি-
না হয় তুমি এসো
ঝড় হয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাও
যেখানে খুশি যেভাবে খুশি
আজ যে আমার ডানা মেলবার ইচ্ছে খুব!
পুরানো দেয়ালে লেপ্টে থাকা শ্যাওলা
তারওপর ফার্ন গাছটা এখানে নেই আর
ঝড় হয়ে এসো না
চল দু’জন খুঁজি দেয়াল!
শানবাধাঁনো ঘাটে নতুন বউ
কলসি ভরা পানি তার
আনাড়ি হাতে ধরা কোমরে ছলকে ছলকে যায়।
ঝড় হয়ে এসো না তাকে খুঁজি।
কত ঝড়ে কত কি ওড়ে
একটা ঝড় হয়ে উড়িয়ে না নিলে যদি
এবার তবে-
ঘাটের কোলে ঘাটের মরা হব।
১৮ এপ্রিল, ২০১৭। আদাবর।
যুগলপথ
এটা একটা সম্পর্ক
মুখোমুখি শুধু শুধু বসে থাকা
দিনগুলোকে সঙ্গী করে
পাশে পাশে চলতে থাকা|
এটা একটা সম্পর্ক
মুখোমুখি বসে ইচিং বিচিং খেলা
কাঠবিড়ালীটা পালাবে জেনেও ছুটতে থাকা যুগলপায়ে
ফড়িং আর প্রজাপতির পিছু ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে
বসে পড়া মুখোমুখি|
এটা একটা সম্পর্ক
রাত বিরাতে হাঁটতে যাওয়ার জন্য ছটফট করা
কিন্তু কোথাও না গিয়ে ঘরের মেঝেতে
মাদুর বিছিয়ে পা ছড়িয়ে দেওয়া
পাশাপাশি।
এটা একটা সম্পর্ক
খাওয়ার টেবিলেই হবে যত রাজ্যের কথা বলে
অপেক্ষায় থাকা দিনমান
তারপর একটাও কথা না বলে উঠে পড়া।
এটা একটা সম্পর্ক
এলেবেলে চিন্তা নিয়ে রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়া
পাহাড় না সমুদ্র ভালো এই তর্কে অযথাই জড়িয়ে পড়া
তারপর মুখ ফিরিয়ে গাল ফুলিয়ে রাখা।
এই সম্পর্কের নাম কি?
২৮ মার্চ, ২০১৭।
আদারব।
নাকফুল
নাকফুলটা আমার ছুঁতে দিতাম না কিছুতেই
আর সেটা তোমার ছোঁয়া চাই-ই চাই
তারজন্য কত যে ছলা কলা
তোমার!
একদিন মনে আছে-
তুমি আমার চায়ের কাপে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিলে
কি দারুণ সুবাস ছড়াচ্ছিল ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ থেকে!
তাড়াহুড়ায় করে ফেললে ভুলটা
চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই চিৎকার করে উঠলে তুমি।
আর আমার কাপটা হাত থেকে পড়ে গেল ভেঙ্গে।
হঠাৎ চিৎকারে।
হাহাকার করে বলে উঠলে তুমি
যাহ্! আজও ছোঁয়া গেল না নাকফুলটা।
আমার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চোখ রেখে তুমি বললে,
ওষুধ মেশানো কাপটা আমার হাতেই যে রয়ে গেল!
কতকাল আগের কথা!
জানো, এখন আমার এমনিতেই ঘুম পায়
ওষুধ লাগে না।
নাকফুলও পরি না আমি এখন আর
নাকফুলটা তোমার কাছে স্পর্শ হীনই রয়ে গেল।
২৪ এপ্রিল, ২০১৭।
আদাবর।